কুতুববাগ দরবার শরীফের মহাপবিত্র ওরছ শরীফ ও বিশ্ব জাকের ইজ্তেমা ২০১৪-এর ছবি। মঞ্চে বসা শাহসুফি আলহাজ্ব মাওলানা হযরত জাকির শাহ্ নকশ্বন্দী মোজাদ্দেদী কুতুববাগী (মা:জি:আ:) কেবলাজান হুজুর (মাঝে), বাঁ দিক থেকে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা, বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আলহাজ্ব হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, থাইল্যান্ড সরকারের উপদেষ্টা মি. কবিত ও নাইজিরিয়ান নাগরিক মি. অ্যাডাম আলোকচিত্র : আত্মার আলো
কবি নাসির আহমেদ
(লেখক পরিচিতিঃ জনাব নাসির আহমেদ একজন বিশিষ্ট কবি এবং লেখক। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত একজন কবি। তিনি বিটিভির নিউজ এডিটর হিসাবে বর্তমানে কর্মরত আছেন।)
আমার প্রাণপ্রিয় মুর্শিদ ইহকাল-পরকালের বান্ধব খাজাবাবা হযরত কুতুববাগী ক্বেবলাজানের সঙ্গে পরিচয়, আমার জীবনের এক অসাধারণ ঘটনা। জীবনের কঠিন লগ্নে তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ। আমি তখন নানামুখী হতাশায় নিমজ্জিত। এক দিকে লিভার সিরোসিসে প্রায় নিরাময়হীন অনিশ্চত চিকিৎসা চলছে। অন্যদিকে হার্ড অ্যাটাকের পরে রিং পরানো হয়েছে। শরীরের শক্তি নিঃশেষ; কিন্তু তখনও হতাশা ঠেলে আমি আশার স্রোতে ভেসে তীরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছি। ঠিক এরকম আশা-নিরাশার জটিল এক মুহূর্তে বাংলাদেশ শুল্ক বিভাগে কর্মরত এস এম শাহজাহান সাহেব আমাকে একদিন খাজাবাবার কথা বললেন। আমি তখন যে বাড়িতে ভাড়া থাকি সেই বাড়ির মালিক আবুল হোসেন সাহেব তার কলিগ। সেই সুবাদে আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। একই বাড়িতে প্রায় সতেরো বছর ছিলাম। ফলে আবুল ভাই তার স্ত্রী, পুত্র-কন্যাসহ তার বন্ধুমহলেও ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম আমি। লেখক-সাংবাদিক হিসেবে আমাকে নিয়ে তাদের গর্বও ছিল। ফলে শাহজাহান ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে সময় লাগেনি। তাছাড়া আমার স্ত্রীকে তিনি ছোট বোন বলে ডাকতেন। কারণ ওর বড় ভাই শুল্ক বিভাগে চাকরি করতেন। তার নামও শাহজাহান। এরকম অবস্থায় যখন শাহজাহান ভাই আমার স্ত্রীকে বললেন, ছোট বোন ভাইকে আমি একটু খাজাবাবার কাছে নিয়ে যেতে চাই। তখন আমার স্ত্রী একটু অবাকই হলেন। কারণ তখনও বিছানা থেকে ওঠার মতো শক্তি নেই। অগত্যা পরম বিশ্বাসের ওপর ভর করেই আমি ওই শরীর নিয়ে ফার্মগেটসংলগ্ন খামারবাড়ীর পেছনে খাজাবাবা কুতুববাগীর মনিপুরীপাড়াস্থ খানকা শরীফে একদিন শেষ বিকালে এসে উপস্থিত হলাম। তখনও মাগরিবের আজান হয়নি। আমি বাসা থেকেই অজু করে পাকসাফ হয়ে এসেছিলাম। দয়াল খাজাবাবার হুজরায় আমাকে নিয়ে গেলেন শাহজাহান ভাই। তিনি তাঁর কদমবুছি করলেন। দেখাদেখি আমিও দয়ালের পাক কদম ছুঁয়ে সালাম করলাম। আমার ভেতরে যেন বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে গেল মুহূর্তেই। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, হুজরা শরীফে ঢোকামাত্র আমি খাজাবাবার নূরানী চেহারা মোবারক দেখে চমকে উঠেছিলাম। দেখামাত্র মনে হয়েছে, এমন সৌম্যকান্ত দীপ্তিমান মুখশ্রী কোনো সাধারণ মানুষের হতে পারে না। তাঁর চেহারা মোবারক থেকে যেন সোনালি জোছনার আভার মতো আলো ঠিকরে বের হচ্ছিল। আমি তাঁকে সালাম করতেও ভুলে গেলাম। শাহজাহান ভাই সালাম করার পরে হঠাৎ মনে হলো, আরে আমি তো সালাম করিনি। ভক্তিতে আমার সর্বাঙ্গে শিহরণ হলো। মনে হলো যেন কোনো মহাপুরুষের সান্নিধ্যে এসেছি আমি। বাবা আমার পারিবারিক পরিচয় ও পেশাসহ অনেক কিছু খুটে খুটে জিজ্ঞেস করলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর এমন মধুর আর এত ছোট করে অনুচ্চস্বরে তিনি কথা বলেন, শুনলে মুগ্ধ হবেন যে কেউ। আমি তাঁর কথা শুনে এবং তাঁর নূরানী চেহারা মোবারক দেখে বিহ্বল হয়ে গেলাম।
শাহজাহান ভাই বাবাকে আমার অসুস্থতার কথা কিছুটা জানালেন। বাবাজান বললেন, বাবা আল্লাহর ওপর ভরসা রাখেন। মালিক দয়া করবেন। আপনাকে সমাজের জন্য দরকার আছে। আপনার দ্বারা অনেক মানুষের কল্যাণ হবে। আমি মাবুদ মাওলার আছে আপনার জন্যে দয়া চাইব। আপনি কি বাইয়াত হবেন? আমি মুহূর্তও না ভেবে সঙ্গে সঙ্গে বললাম, জ্বি বাবা হবো। বাবাজান তাঁর পবিত্র শাহাদাত আঙুল দিয়ে আমার হৃদপি- বরাবর ছুঁয়ে বললেন, এইখানে বাবা আদম (আঃ)-এর জেরে কদম। খেয়াল করবেন আল্লাহ আল্লাহ জিকির হবে এখানে। শরিয়তের ছোট-বড় সব নিয়ম পালন করবেন। মারেফাত হাসেল সহজ হয়ে যাবে। মানুষের উপকার করতে চেষ্টা করবেন। নিজেকে তুচ্ছ জানবেন। অজিফা শরিফ হাতে দিয়ে বললেন বাবা, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবেন। নামাজ বাদ কিছু জিকির-আসকার, অজিফা-আমল আছে, ঠিকমতো আদায় করবেন। এরই মধ্যে মাগরিবের আজান হলো। সবাই জামাতে নামাজ আদায় করলাম খাজাবাবার সঙ্গে। আমার মনে হলো, আমার আর কোনো শারীরিক দুর্বলতা নেই। অথচ একদিন পর একদিন হাই পাওয়ার ইন্টারফেরন থেরাপি নিয়ে মাথার চুল অর্ধেক পড়ে গেছে। শরীরের চামড়া লুজ হয়ে গেছে। শরীর এমন দুর্বল যে, বিছানা থেকে ওঠার শক্তি হয় না। অথচ সেই আমাকে বাবা হুকুম দিলেনÑ বাবা আপনি শিক্ষিত মানুষ, আপনার রক্তে অলির রক্ত আছে। আপনি মাইকে যান। কিছু কথা বলেন। আমি অবাক হয়ে গেলাম শুনে। কারণ আমার মা-বাবা যে তরিকাপন্থী এবং ভোলার পীরসাহেব শাহসুফি কুতুবুল এরশাদ হযরত আলহাজ্ব হাবীবুর রহমান (রঃ) সাহেবের মুরিদ, সে কথা তো আমি বলিনি। আমার মনে প্রশ্ন জাগলো তাহলে, এ কথা তিনি কেমন করে জানলেন? সেদিনও বুঝিনি অলিআল্লাহরা যে কত বড় অন্তর্যামী শক্তির অধিকারী হয়ে থাকেন।
সেদিন খাজাবাবা আমাকে হুকুম দিলেন মাইকে কিছু বলার জন্য। যতদূর মনে পড়ে সেদিন সাপ্তাহিক গুরুরাত্রি ছিলো। অনেক ভক্ত-জাকের-আশেকান উপস্থিত ছিলেন। মুর্শিদ ক্বেবলার নির্দেশে আমি বাইয়াত গ্রহণের পরই এমন কিছু কথা মাইকে দাঁড়িয়ে বললাম, যা ভাবলে আজো অবাক হই। কে আমাকে দিয়ে এত কথা বলিয়ে নিলেন? আমি তো গুরুতর অসুস্থ একজন রোগী। গায়ে জ্বর নিয়ে কেমন করে রাত পর্যন্ত ওখানে থাকলাম! বিস্ময়কর হলেও সত্য, খাজাবাবার তাওয়াজ্জুহ পেয়ে আমি যেন নতুন শক্তি লাভ করলাম।
রাতে যখন বাসায় ফিরলাম, আমাকে দেখে বাসার সবাই অবাক! সন্ধ্যার আগে যে আমি বের হয়েছিলাম, ঘরে ফিরলাম অন্য এক আমি হয়ে। নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু করলাম ওই রাত থেকেই। এশার পর অজিফা, ফজর বাদ ফাতেহা শরীফ ও খতম শরীফ শুরু হলো এবং চলছে। আমার মহান মুর্শিদের দোয়া আর দয়াল আল্লাহপাক আমার জীবনটাই বদলে দিলেন। লাখো শুকরিয়া আল্লাহর দরবারে। খাজাবাবা কুতুববাগীর সান্নিধ্যে না এলে এ জীবন অন্যরকম হতো যা কারো কাম্য হতে পারে না।
খাজাবাবা অতি অল্পদিনের মধ্যে আমাকে আপন করে নিলেন। প্রথম যেদিন এসেছিলাম, সেদিনই তাঁর প্রতি আমার যে ভক্তি ও বিশ্বাস মনে দানা বেঁধেছিল, দিনে দিনে তা কেবলই বেড়েছে। আর নতুন নতুন বিস্ময় আমাকে মুগ্ধ করে চলেছে। শৈশবে কৈশোরে আখেরী নবী হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ)-এর জীবনচরিত্র পড়ে মনে মনে যে ছবি আঁকা হয়ে গেছে তাঁর, সেই ছবিই যেন বাবার মধ্যে খুঁজে পেলাম। কী যে নম্র, ভদ্র আর শান্ত একজন মানুষ! এই সমাজে এমন অহংকারমুক্ত, নিলোর্ভ, শান্তি ও সম্প্রীতির পথের সংস্কারবাদী মানুষ হতে পারেন, বাবাকে না দেখলে তা জানা হতো না। মা-বোনদের প্রতি শ্রদ্ধা, ছোটদের প্রতি স্নেহ খাজাবাবা কুতুববাগীর মধ্যে এত প্রগাঢ়, মানবসেবায় এত কোমল তাঁর প্রাণ, তা চোখে না দেখলে বুঝতে পারবেন না কেউ। আল্লাহর বন্ধু আখেরী নবী কারও মনে আঘাত দেননি কোনও দিন। বাবাজানকেও কারো মনে আঘাত দিতে দেখিনি বা শুনিনি। ছোট শিশুদেরকেও বাবাজান আপনি সম্বোধন করেন।
কেউ যদি প্রশ্ন করেন, বাবার এখানে এসে কী পেয়েছেন? এক কথায় বলবো মানুষ হওয়ার শিক্ষা। মানবতার শিক্ষা। দয়া-মায়া-স্নেহ-প্রীতি এবং সবচেয়ে বড় কথা মানবসেবার যে অতুলনীয় আদর্শ বাবার জীবনে, তা অনুশরণ করতে পারলে একজন মানুষ সত্যিকার মানুষ হয়ে উঠতে পারে। এরকম মানুষ সমাজে যত বাড়ে, ততই সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বাড়তে পারে। আমার দয়াল মুর্শিদ ক্বেবলা সবসময় ধৈর্যশীলতার পরিচয় দেন। কারণ তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন যে, সবরকারীর সঙ্গে আল্লাহ থাকেন। খাজাবাবা কুতুববাগীকে যদি কেউ অনুস্বরণ করতে পারেন, তাঁর জীবন বদলে যাবে। খাঁটি মানুষ হয়ে যাবে। এতে কোনো সন্দেহ বা সংশয় নেই।
আমার দয়াল খাজাবাবা আমাদের যুগের রহমত স্বরূপ, তার প্রমাণ অন্য ধর্মের মানুষও বাবাকে দেখে ভক্তিতে আপ্লুত হন। আমার বন্ধু সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘরের পরিচালক কবি রবীন্দ্র গোপ ৭-৮ বছর আগে আমার সঙ্গে খাজাবাবার কাছে এসেছিলেন। বাবাকে দেখে রবীন্দ্র গোপ বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। আমাকে বললেন, আরে কবি! উনি তো মানুষ নন, উনি দেবতা। সত্যি উনি দেবতা। এরপর বাবার কদমে ভক্তিপূর্ণ সালাম জানিয়েছিলেন রবীন্দ্র গোপ।
আমার মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে বাবার নূরানী চেহারা মোবারক দেখে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার ধূপছড়ির বিশিষ্ট ব্যবসায়ী স্বপন কুমার দত্ত অভিভূত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, দাদা উনি কে? আমি জবাব দিলাম, আমার মুর্শিদ, আধ্যাত্মিক গুরু। এ কথা শুনে স্বপন দা মুগ্ধ হয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ছবির দিকে। বললেন, দাদা উনি তো সাধারণ কেউ নন। উনি দেবতা। আচ্ছা আমি কি একটু কথা বলতে পারি বাবার সঙ্গে? আমি বললাম, যদি বাবার দয়া হয়। ফোনে সংযোগ করে দিলাম। বাবার কণ্ঠস্বর শুনে তিনি বিহ্বল হয়ে গেলেন। স্বপন কুমার দত্ত খাজাবাবা কুতুববাগীকে দেখার জন্য প্রায় আকুল হয়ে উঠলেন এবং কিছুদিন পর বাংলাদেশে এলেন। বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন, সঙ্গ নিলেন। আত্মতৃপ্তির কথা তিনি নিজেই উপস্থিত সবার সামনে প্রকাশ করে গেছেন। সেই থেকে তিনি এবং তাঁর মা-সহ গোটা পরিবার খাজাবাবা কুতুববাগীকে পরম ভক্তি করেন। থাইল্যান্ডের সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী এবং বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মি. কোবিত সাহেব। তিনি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হয়েও বাবাকে যে কী গভীর শ্রদ্ধা করেন, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। শত ব্যস্ততা ফেলে বাবার ওরছ শরীফ ও বিশ্বজাকের ইজ্্তেমায় অংশ নিতে প্রতি বছর ছুটে আসেন। থাইল্যান্ডে খাজাবাবার নামে তৈরি করেছেন খানকা শরীফ এবং প্রতি বছর বাবাজানকে সেখানে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যান। তিনি বাবার সম্পর্কে ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বারবার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করেন ‘হলিবাবা, হলিবাবা’ অর্থাৎ পবিত্র। আমার দয়াল মুর্শিদ খাজাবাবা কুতুববাগী ক্বেবলাজান হুজুর সত্যিকারে একজন পবিত্র মানুষ এবং সমাজ সংস্কারক।
(এই লেখাটি “মাসিক আত্মার আলো” এপ্রিল, ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় )