কোরআন, হাদিস মতে ছদকা এবং মান্নতের বিধান

শাহসুফি আলহাজ্ব মাওলানা সৈয়দ হযরত জাকির শাহ নকশবন্দি মোজাদ্দেদি

যমযম কূপ বিলুপ্ত হওয়ার পর দয়াল নবীজির দাদা খাজা আবদুল মোত্তালিব যমযম কূপ আবিষ্কার করার জন্য স্বপ্নে আদেশপ্রাপ্ত হলেন। একই স্বপ্ন বারবার দেখার পর আল্লাহ তায়া’লা জানিয়ে দিলেন, ‘প্রভাতে এক স্থানে পিপিলিকার বাসা দেখিতে পাইবে এবং কাক ঠোঁট দ্বারা মাটি খুঁড়িতেছে’। খাজা আবদুল মোত্তালিব সেই জায়গায় এসে বাস্তবে দেখতে পেলেন এবং হারেসকে সঙ্গে নিয়ে মাটি খনন করতে লাগলেন। এইস্থানে অল্পকিছু মাটি খননের পরেই কূপের মুখ বের হলো, খাজা আবদুুল মোত্তালিব আল্লাহর নামের ধ্বনি দিয়ে কূপের ভিতর থেকে দুটি স্বর্ণের হরিণ, তরবারি ও লৌহবর্ম উত্তোলন করলেন। এসব মালামাল নিয়ে কোরাইশদের অন্যান্য গোত্রের মধ্যে কলহ সৃষ্টি হলো। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে আবদুুল মোত্তালিব লটারির প্রস্তাব করায় সবাই রাজি হলো। লটারি শুরু হলো। লটারিতে স্বর্ণ-হরিণ দুটি কাবা গৃহের নামে উঠল এবং অস্ত্রসমূহ আবদুুল মোত্তালিবের নামে উঠল। কোরাইশগণ ফাঁকা গেল। এসব ঘটনার পর নিজে স্বনির্ভর হওয়ার জন্য আবদুল মোত্তালিব আল্লাহর দরবারে দশটি পুত্রসন্তান লাভের আশায় মান্নত করলেন- আমার দশটি পুত্রসন্তান হলে একটি সন্তান আল্লাহর নামে কোরবানি করব। আল্লাহ তায়া’লা তাঁর দোয়া কবুল করে দশটি পুত্রসন্তান দান করলেন।

আল্লাহ তায়া’লার কুদরতে আবদুল মোত্তালিব একে একে দশটি পুত্রসন্তান লাভ করলেন, সর্ব কনিষ্ঠ পুত্র হলেন খাজা আবদুল্লাহ এবং তাঁর বয়স হওয়ার পর আবদুল মোত্তালিবের মান্নত পূরণ করা জরুরি হয়ে পড়ল। একদিন তিনি তার সব পুত্রকে ডেকে মান্নত আদায়ের বিষয় জ্ঞাত করলেন এবং একজনকে কোরবানির জন্য নির্ধারিত করার উদ্দেশ্যে লটারি করলেন। লটারিতে খাজা আব্দুল্লাহর নাম উঠল। পিতা-পুত্র উভয়ে মান্নত পূরণের জন্য প্রস্তুত হলেন এবং আবদুল মোত্তালিব এক হাতে ছুরি, অপর হাতে আবদুল্লাহকে নিয়ে কোরবানির স্থানের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। সেকালে মদিনায় একজন বিশিষ্ট ঠাকুরাণী ছিল। আবদুল মোত্তালিব কতিপয় লোকসহ ঠাকুরাণীর কাছে কোরবানির বিষয় জানালে তিনি পরে আসতে বললেন। সে যুগের প্রথা অনুযায়ী একজন মানুষের জীবনের বিনিময় ছিল দশটি উট। অতএব, ঠাকুরাণী ফয়সালা করলেন দশটি উট এবং আবদুল্লাহ উভয়ের মধ্যে লটারি হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত খাজা আবদুুল্লাহর নাম পরিবর্তন হয়ে উটের নাম না আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত উটের সংখ্যা বাড়াতে থাকবে। লটারিতে উটের সংখ্যা বাড়তে থাকল। যখন একশ উট পূর্ণ হলো তখন খাজা আবদুুল্লাহর নাম না এসে একশ উটের নাম উঠল। তখন একশ উট কোরবানি করে দিলেন এবং খাজা আবদুুল্লাহ বেঁচে গেলেন। এখানে প্রকাশ থাকে যে, মান্নতের কারণেই খাজা আবদুল্লাহকে আল্লাহ তায়া’লা বাঁচিয়ে দিলেন।উল্লিখিত ঘটনায় প্রমাণ হলো যে, কোরআন ও হাদিস অনুযায়ী অলি-আল্লাহদের দরবারে আল্লাহর রাস্তায় কোনো কিছুর নিয়তে মান্নত করা বিলকুল জায়েজ।

মান্নত বা ছদকা প্রমাণ হওয়ার বিষয়ে কোরআনের দলিল

হযরত জাকারিয়া (আ.)-এর জবানের কথা, যখন তিনি আল্লাহ তায়া’লার নবী হিসেবে বাইতুল মোকাদ্দাসের রক্ষণাবেক্ষণ ও সেবা-যতেœর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন, তখন বনী ইসরাইলের হেনা নামে এক নেককার ও ধর্মভীরু মহিলা ছিলেন তাঁর স্বামীর নাম ছিল ইমরান। কথিত আছে যে, হেনার এক বোনকে হযরত জাকারিয়া (আ.) বিবাহ করেছিলেন। সে সূত্রে হেনা হযরত জাকারিয়া (আ.)-এর শ্যালিকা। তখন তিনি আল্লাহর দরবারে মান্নত করেন।

সূরা-আল ইমরান, আয়াত-৩৫
“ইয ক্ব-লাতিম রাআতু ইমরা-না রাব্বি ইন্নী নাযারতু লাকা মা-ফী বাত্বনী মুহাররারান ফাতাক্বাব্বাল মিন্নী, ইন্নাকা আনতাস সামী’উল আলীম।
অর্থ- ইমরানের স্ত্রী বললেন, তাঁর গর্ভে যে সন্তান আছে, সে ভূমিষ্ঠ হলে তাকে বাইতুল মোকাদ্দাসের সেবক হিসেবে উৎসর্গ করবেন সুতরাং আমার পক্ষ থেকে তা গ্রহণ কর, নিশ্চয় তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

যাঁদেরকে এভাবে মান্নত করা হতো, তাঁরা সারাজীবন বাইতুল মোকাদ্দাসের সেবায় এবং ইবাদাত-বন্দেগির মাধ্যমে নিজ নিজ জীবন অতিবাহিত করত। এ ধরনের নিয়মের কারণে বাইতুল মোকাদ্দাসের খাদেম ও সেবকের সংখ্যা ছিল অনেক। তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাদির জন্য মুসলমানগণ উদারহস্তে দান করতেন। সেবকের সংখ্যা যত বেশি হোক না কেন, তাদেরকে কোনো দিন অসহায় বা অভাবে দিন কাটাতে হয়নি।

হেনা গর্ভধারণের নয় মাস পরে একটি কন্যাসন্তান প্রসব করলেন এবং তার নাম রাখলেন ‘মরিয়ম’; কিন্তু মান্নতের বিষয়ে তিনি খুব নিরাশ হলেন। কারণ ইতোপূর্বে কোনো কন্যাসন্তান বাইতুল মোকাদ্দাসের সেবক হিসেবে কেউ দান করেননি। তাই বিষয়টি হেনার কাছে নৈরাশ্যজনক বলে বোধ হয়েছে। তার ধারণা ছিল হয়ত কন্যাসন্তানকে আল্লাহ তায়া’লা সেবক হিসেবে কবুল করবেন না এবং মসজিদের প্রধান কর্মকর্তাবৃন্দও এতে সম্মতি দেবেন না। এমতবস্থায় তিনি বিষয়টি ভেবে খুবই নিরাশ হলেন এবং কেঁদে কাটাতে লাগলেন। আল্লাহ- তায়া’লা তখন হেনাকে উদ্দেশ করে বললেন, হেনা তুমি যা প্রসব করেছ, তা আল্লাহ তায়া’লা ভালোভাবে জানেন। মরিয়ম পুরুষ না হলেও আল্লাহ তায়া’লা তাকে কবুল করেছেন এবং তার মর্যাদা যথেষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাকে নবী জাকারিয়া (আ.)-এর কাছে দাও। হেনা আল্লাহ তায়া’লার কাছ থেকে সান্ত¡নাবাণী পেয়ে নিশ্চিন্ত হলেন। অতঃপর সাত বছর পর্যন্ত মরিয়মকে প্রতিপালন করে বড় করে তুললেন। তারপরে একদিন মরিয়মকে এনে হযরত জাকারিয়া (আ.)-এর কাছে হাজির করে বললেন, হে আল্লাহর নবী, আমি মান্নত করেছিলাম আমার সন্তানকে আল্লাহর ঘরের খেদমতে দিব। দুভার্গ্যবশত আমি একটি কন্যাসন্তান প্রসব করেছি। তবুও আমার মান্নত ঠিক রাখার জন্য একে আপনার হাতে তুলে দিতে এসেছি। আপনি মেহেরবাণী করে একে কবুল করে নিন।হযরত জাকারিয়া (আ.) তখন মসজিদের মুসল্লিগণকে ডেকে বললেন, আপনাদের মধ্যে কে আছেন যে, এ মেয়েটির ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে রাজি আছেন? মুসল্লিগণ মরিয়মের ললাটে এক জ্যোর্তিময় নূর দেখে তাঁর ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে সবাই একসঙ্গে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। হযরত জাকারিয়া দেখলেন, সকলেই দায়িত্ব গ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। এমতবস্থায় স্বাভাবিকভাবে কারো হাতে মরিয়মের প্রতিপালনের দায়িত্ব অর্পণ করার মধ্যে এক জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। তখন তিনি লটারির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হলেন।

তাওরাত কিতাব লেখার কাজে যে কলম ব্যবহার হতো, সে কলমটি এক এক করে সবার হাতে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। এ কলমটি পানিভর্তি এক পাত্রের মধ্যে ছেড়ে দিলে যার হাতের কলম পানিতে ডুববে না, তিনি মরিয়মের প্রতিপালনের দায়িত্ব লাভ করবেন। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে এক এক করে পরস্পর পানির পাত্রে কলম ফেলতে আরম্ভ করলেন। একে একে সবার হাতের কলম ডুবে গেল। যখন হযরত জাকারিয়া (আ.) কলম পানিতে ফেললেন, তখন কলম আর পানিতে ডুবলো না, পানির ওপর ভেসে থাকল। তখন সবাই হযরত জাকারিয়া (আ.)কে মরিয়মের প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ করলেন। তিনি মরিয়মের জন্য বাইতুল মোকাদ্দাসের একপাশে একটি হুজরা বা কক্ষ নির্ধারণ করে দিলেন। মরিয়ম সেখানে বসে এবাদত-বন্দেগি করবেন এবং শুধু জাকারিয়া (আ.)-এর বাসায় তিনি যাতায়াত করবেন। হযরত জাকারিয়া (আ.)-এর স্ত্রী মরিয়মের ললাটে অসাধারণ এক উজ্জ্বলতা লক্ষ করে বুঝতে পারলেন এ মেয়ে কোনো সাধারণ মেয়ে নয়। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট কোনো এক মহান ব্যক্তিত্ব লুকিয়ে আছে তাঁর মধ্যে। ভবিষ্যতে এর সন্তানদের মধ্যে হয়ত কাউকে আল্লাহ তায়া’লা মহামানবের মর্যাদা দান করবেন। তাই তিনি মরিয়মকে যথেষ্ট আদর করতেন এবং প্রাণপণ সেবা-যত্ন করতেন।প্রথম জীবনে মরিয়ম অধিকাংশ সময় খালার কাছে কাটাতেন। পরে অধিকাংশ সময় মসজিদে তাঁর নির্দিষ্ট হুজরা বা কক্ষে ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। হযরত জাকারিয়া (আ.) বাইরে থেকে কক্ষের বা হুজরার তালা বন্ধ করে রাখতেন। এক দিন হযরত জাকারিয়া (আ.) মরিয়মকে তালাবদ্ধ করে রেখে অন্য জায়গায় এসে এমন সমস্যায় পতিত হলেন যে, চারদিন তিনি আর হুজরায় যেতে পারেননি তিনি এক রকম ভুলে গিয়েছিলেন। চারদিন পর হঠাৎ যখন মরিয়মের কথা তার মনে পড়ল, তখন তিনি আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। চারদিন যাবৎ তিনি মরিয়মের খানা-পিনা বা খোঁজখবর নিতে পারেননি। এর মধ্যে তাঁর অদৃষ্টে না জানি কী দুর্দশা ঘটে গেছে। এই চিন্তায় তিনি পাগলের মতো দৌড়ে এসে কক্ষের তালা খুলে দেখলেন মরিয়ম নামাজে দন্ডায়মান আছেন। তার চারপাশে নানা রকম ফলমূল ও খাদ্যের সমারোহ। তখন তিনি পাঠ করলেন ‘আলহামদুলিল্লাহ’।

মরিয়ম নামাজ শেষ করে খালুজানকে সালাম দিলেন। হযরত জাকারিয়া (আ.) দুঃখিত ও লজ্জিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, মা তুমি এ কদিন কেমন ছিলে? আমি এক মহা বিপদের মধ্যে পড়ে তোমার কথা ভুলে গিয়েছিলাম, যার ফলে চারদিন তোমার খবর নিতে পারিনি। তুমি এজন্য আমাকে ক্ষমা করো। হযরত মরিয়ম (আ.) বললেন, খালুজান আপনি কী বলছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না? আপনি ভোরবেলা এসব খাদ্য আমাকে দিয়ে গেলেন। এখন দুপুর না হতেই আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করছেন আমি এ কদিন কেমন ছিলাম! কদিন আপনি কোথায় গেলেন? আপনি তো নিয়মিত দৈনিক দুবার আমার খোঁজখবর নিয়েছেন এবং আমার খাদ্য এখানে পৌঁছে দিচ্ছেন। তবে গতদিনে খাদ্য সম্ভার ছিল একটু ব্যতিক্রম। এতো রকমারি খাদ্য আপনি আর কোনো দিন নিয়ে আসেননি, যার দশ ভাগের এক ভাগও আমি সারাদিন খেতে পারিনি। এখন আপনার কথার প্রকৃত অর্থ আমার বোধগম্য হচ্ছে না।

হযরত জাকারিয়া (আ.) তখন আল্লাহ তায়া’লার কুদরতি লীলার নিদর্শন উপলব্ধি করলেন এবং বললেন, মা তুমি যা বলেছ সবই সত্য; কিন্তু এর মধ্যে আল্লাহ তায়া’লার এক রহস্যময় কীর্তি ও নিদর্শনের বিকাশ ঘটেছে। আমি চারদিন আগে তোমাকে তালাবদ্ধ অবস্থায় রেখে যাওয়ার পরে এক বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতির সম্মুখীন হই। যে কারণে তোমার কথা সম্পূর্ণ ভুলে যাই। চারদিন পর যখন তোমার কথা আমার স্মরণ হয় তখন আমি পাগলের মতো এখানে ছুটে এসে তোমার সামনে বিভিন্ন রকম খাবার সজ্জিত এবং তোমাকে নামাজে দ-ায়মান দেখে আমি কিছুটা শান্ত হই। আরও অবাক হই বিগত চারদিন যাবৎ আমি তোমার খবর নিতে পারিনি। আল্লাহ তায়া’লা তোমাকে তা আদৌ আঁচ করতে দেননি। তিনি ফেরেশতাদের দিয়ে তোমার খোঁজখবর নিয়েছেন। এটি ছিল আল্লাহ তায়া’লার এক অপূর্ব রহমতের নিদর্শন। মা তুমি নিয়মিত আল্লাহ তায়া’লার বন্দেগি করে যাও। তোমার অদৃষ্টে আল্লাহ তায়া’লা হয়তো আরও অনেক নেয়ামত রেখেছেন, যা তুমি পর্যায়ক্রমে লাভ করতে সক্ষম হবে। পরবর্তীতে দেখা গেল, আল্লাহ পাকের অপার লীলায় সেই হুজরায় মরিয়মের গর্ভে হযরত ঈশা (আ.) এলেন।

মান্নত করে জাহাজের যাত্রীদের জীবন বাঁচল

একদিন এক বৃদ্ধা এসে হযরত দাউদ (আ.)-এর কাছে নালিশ করলেন, হে আল্লাহর নবী! বাজার থেকে আমি কিছু আটা নিয়ে আসার পথে হঠাৎ বাতাস আমার আটাগুলো উড়িয়ে নিয়ে যায়। এখন আমি খালি হাতে বাড়ি গিয়ে মেহমান ও ছেলে-মেয়েদের কী খাওয়াবো? অতএব, আপনি বাতাসের এই অপরাধের বিচার করুন। দাউদ নবী বললেন, মা বাতাসের বিচার কীভাবে করবো? বাতাস আমার অধীনে নয়। অতএব, তার পরিবর্তে কিছু আটা দিচ্ছি, তুমি আটা নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। বুড়ি মা আটা নিয়ে যখন বাড়িতে রওনা দিলেন। পথের মধ্যে হযরত সোলায়মান (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। তিনি বললেন, হে বুড়ি খলিফার কাছে ভিক্ষা নিতে এসেছিলে? বৃদ্ধা বললেন না বাবা, আমি এসেছিলাম বাতাসের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার উদ্দেশ্যে। হযরত সোলায়মান (আ.) বিস্তারিত শুনে বললেন, তুমি খলিফার নিকটে পুনরায় যাও এবং বল আমি আপনার নিকট এসেছি বিচার প্রার্থী হয়ে, ভিক্ষা নিতে আসিনি। বৃদ্ধা পুনরায় দাউদ (আ.)-এর কাছে গিয়ে আটা ফেরত দিলেন এবং অভিযোগ পেশ করলেন। তখন দাউদ (আ.) বুড়িকে রাজি করিয়ে দশ মণ আটা দিলেন। বুড়ি মা আটার বস্তা বহনকারীদের নিয়ে যখন পূর্বের স্থানে পৌঁছলেন, তখন সোলায়মান (আ.) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন কী হে বৃদ্ধা! তোমার অভিযোগের বিচার পেয়েছ, না ভিক্ষা বাড়িয়ে নিয়েছ? তখন বৃদ্ধা খলিফার ব্যবহারের কথা বললেন। তখন হযরত সোলায়মান বললেন, তুমি আরও অনেক কিছু পাবে। এর জন্য তুমি পুনরায় খলিফার নিকট গিয়ে বাতাসের বিচারের প্রার্থী হও। ভিক্ষা নিয়ে বিদায় হইও না, বৃদ্ধা দেখল খলিফার নিকট গেলেই তার সম্পদ বৃদ্ধি পায়। অতএব, শাহজাদার মতো এক বিরাট ব্যক্তিত্বের কথায় তিনি আবার যাবে। তাতে তার ভয়ের কোনো কারণ নেই। খলিফা রাগ করলেই তিনি শাহজাদা সোলায়মান (আ.)-এর কথা বলে দেবেন। এই সমস্ত চিন্তা করে বৃদ্ধা পুনরায় খলিফার কাছে গিয়ে বললেন। হুজুর অভিযোগের বিচার না করে ভিক্ষা বাড়িয়ে দিলেন। এতে আপনি কেয়ামতের দিন নিজেকে ন্যায় বিচারক বলে দাবি করতে পারবেন না। আমি সেদিন কিন্তু বলব খলিফা আমার অভিযোগের বিচার করেননি। খলিফা বৃদ্ধার কথা শুনে বললেন, তোমাকে এসব কথা কে শিখিয়ে দিয়েছে? বৃদ্ধা বললেন, শাহজাদা সোলায়মান (আ.) আমাকে সব কিছু বলে দিয়েছেন। তখন হযরত দাউদ (আ.) শাহজাদা সোলায়মানকে দরবারে ডাকলেন। হযরত দাউদ (আ.) হযরত সোলায়মান (আ.)কে বললেন, তুমি বারবার বৃদ্ধাকে আমার কাছে পাঠিয়ে আমাকে হয়রান করে তুলছ কেন? বাতাস কি আমার অধীন যে, আমি তাকে এনে বৃদ্ধার সামনে বিচার করব? এটা একটা অসম্ভব ব্যাপার। অতএব এ বিষয়ে বৃদ্ধাকে তুমি বারবার কেন পাঠাচ্ছো? হযরত সোলায়মান (আ.) আল্লাহর কাছে বাতাস হাজির করার জন্য দোয়া করার কথা বললেন, হযরত দাউদ (আ.) সোলায়মানকে সঙ্গে নিয়ে হাত উঠিয়ে দোয়া করলেন, সঙ্গে সঙ্গে বাতাস এসে আকৃতি নিয়ে হাজির হয়ে গেল। তখন দাউদ (আ.) বাতাসকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এ বৃদ্ধার আটা কেন উড়িয়ে নিয়েছ? বাতাস উত্তর দিল, হে আল্লাহর খলিফা বৃদ্ধা যখন আটা নিয়ে বাসায় ফিরছিল, তখন গভীর সমুদ্রে একটি জাহাজের তলদেশ ছিদ্র হয়ে যাত্রীরা ও বহু মূল্যবান মালামাল তলিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় যাত্রীরা মান্নত করে, যদি তাদের জাহাজ বিপদ থেকে রক্ষা পায়, তাহলে তারা জাহাজের সব মালামাল গরিব দুঃখীদের দান করে দেবে। আল্লাহ দোয়া কবুল করেন। জাহাজ উদ্ধারের নিমিত্তে আমাকে নির্দেশ প্রদান করেন। আমি তখন বৃদ্ধার আটা উড়িয়ে নিয়ে সে জাহাজের তলদেশের ছিদ্র বন্ধ করে দেই। ফলে জাহাজ ও যাত্রীরা মৃত্যু থেকে রক্ষা পায়। হযরত দাউদ (আ.) বাতাসকে জিজ্ঞেস করলেন, জাহাজটি এখন কোথায়? বাতাস বলল, এইমাত্র এই শহরের প্রান্তে সমুদ্র তীরে নোঙর করেছে। তখন তিনি বললেন, তুমি তাহলে যেতে পার, আমি জাহাজের খবর নিচ্ছি। দাউদ (আ.) জাহাজের যাত্রী ও নাবিকদের ডাকলেন, তারা উপস্থিত হলেন। তিনি বললেন, জাহাজের মালামাল গরিব দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করার অঙ্গীকার করেছ। তাই বৃদ্ধাকে মালামালের অর্ধেক দিয়া দিবে। বাকি অর্ধেক গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করবে। জাহাজের নাবিক ও যাত্রীরা খলিফার আদেশ শিরোধার্য করে নিল। বৃদ্ধাকে তাদের সঙ্গে নিয়ে গেল এবং জাহাজের সমুদয় মালামাল খালাশ করে সঠিকভাবে বণ্টন করে অর্ধেক বৃদ্ধাকে দিয়ে দিল। বাকি অর্ধেক গরিব দুঃখীদের দান করল। এই ঘটনা থেকে জানা গেল, জাহাজের যাত্রীরা এই মহা বিপদ থেকে বাঁচার জন্য মান্নত করল এবং জীবন রক্ষা পেল। পবিত্র কোরআনে এ ঘটনা জানা গেল।

কোরআনের এই ঘটনা দ্বারা প্রমাণ হলো যে, মান্নতের উছিলায় আল্লাহ তায়া’লা মানুষের বিপদমুক্ত করেন, হায়াৎ বৃদ্ধি করেন, বালামছিবত দূর করেন, রিজিক বৃদ্ধি করেন, মান-সম্মান বাড়ান। কাজেই হে সম্মানিত পাঠকগণ! আপনারা গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন যে, কোরআন, হাদিস মতে ছদকা বা মান্নত বিলকুল জায়েজ আছে। তাই দেখা যায় যে, কামেল পীর-মুর্শিদের দরবারে মানুষ আল্লাহর রাস্তায় ছদকা বা মান্নত হিসেবে উট, দুম্বা, মহিষ, ভেড়া, বকরি, মুরগি, চাউল, ডাল, টাকা-পয়সা ইত্যাদি দান করেন। এ সমস্ত মান্নত যখন আল্লাহ তায়া’লা কবুল করেন, তখন মানুষ এই ছদকা-মান্নত কামেল পীর-মুর্শিদের দরবারে নিয়ে হাজির হন এবং ছদকা-মান্নতগুলো কামেল পীর-মুর্শিদগণ মানবের সেবায় বিতরণ করেন।

(Visited 1,309 times, 1 visits today)
Share