মোঃ শাখাওয়াত হোসেন
মাতা-পিতা প্রত্যেক সন্তানের কাছে পরশ পাথর তুল্য। পিতা-মাতার হক আদায় করা প্রত্যেক সন্তানের অবশ্য কর্তব্য। রাসুল (সঃ) মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যব্যবহার করতে বলেছেন। সুতরাং পিতা-মাতার হক আদায় করতে এবং তাদের আদেশ নিষেধ মান্য করতে হবে। আমার পীর-মুর্শিদ খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজান সবসময় বলে থাকেন ‘মা হচ্ছেন মক্কা শরীফ, মা হচ্ছেন মদিনা শরীফ। অর্থাৎ, মক্কা-মদিনাকে যেমন সম্মান করতে হয়, মাকেও তেমনিভাবে সম্মান করতে হবে। এরকম শিক্ষা আমি কোন বই-কিতাবে পাইনি কিংবা কোন মনীষীর কাছে শুনিনি। বাবাজানের পবিত্র মুখে এরকম বাণী শোনার পর আমার মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালোবাসা ও কর্তব্য বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। পীরকেবলাজানের এই মহৎ শিক্ষা যদি আমরা সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তাহলে মাতা-পিতার সঙ্গে ছেলে-মেয়েদের মধুর সম্পর্ক স্থাপিত হবে এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। সন্তান মায়ের নাড়ি ছেড়া ধন, মা সন্তানকে বুকে নিয়ে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা সহ্য করে আদর যতেœ বড় করে তোলেন। যদি সেই সন্তান বড় হয়ে মাকে কষ্ট দেয়, তবে মায়ের দুঃখের কোন শেষ থাকে না। মাতা-পিতাকে কষ্ট দিলে ওই সন্তানের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয় না। সমাজে দেখা যায় অনেকে তাদের বৃদ্ধ মাতা-পিতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসেন। অথচ বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতাকে সন্তানের কাছেই রাখা উচিৎ, ওই বয়সে তাদের বৃদ্ধাশ্রমে রাখা মহা অন্যায়। যদি আমাদের সমাজে সূফীবাদের চর্চা হত এবং খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের মানবতার মহান শিক্ষা ও আদর্শ সকল মানুষ গ্রহণ করতো, তাহলে সমাজের সকল ছেলেমেয়ে তাদের মা বাবাকে অধিক ভালোবাসতো, মান্য করত।
আমাদের সমাজে কিছু সংখ্যক আলেম আছেন, যারা সূফীবাদের বিরোধিতা করেন, কামেল পীর ও অলি-আল্লাহদের বিরোধিতা করেন। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করে। তারা এতোটাই ভয়ংকর যে, তাদের নিজস্ব মতামত সমাজে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বলে থাকেÑ ‘মা-বাবা জীবিত থাকলে পীরের কাছে যাওয়ার দরকার নেই’। অথবা মা-বাবার জীবিত অবস্থায়ই সন্তানকে তাঁদের হক আদায় করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বলা জরুরী মা-বাবার হক কী? তা সঠিকভাবে জানার জন্যই কামেলপীরের কাছে যাওয়া জরুরী। আমার পীরকেবলাজানের কাছে বাইয়াত পড়েছে অথচ মা-বাবার খেদমত করছে না, এমন কোন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাসুল (সঃ) এরশাদ করেছেনÑ ‘তালাবুল এলমে ফারিদাতুন আলা কুল্লি মুসলিমিন ওয়া মুসলিমাতিন’। অর্থ : প্রত্যেক নর-নারীর জন্য এলেম (জ্ঞান) অর্জন ফরজ, (ইবনে মাজা)। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছেÑ জ্ঞান দুই প্রকার যথা: জবানী এলেম এবং কাল্বী এলেম’ (মেশকাত শরীফ)। জবানী এলেম হচ্ছে শরিয়তি এলেম যা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় শিখতে হয়।
এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেনÑ ‘লিকুল্লিন জ্বাআলানা মিন্কুম শিরআতাওঁ ওয়া মিনহা-জ্বা’। অর্থ: আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য দুইটি পথ দিয়েছি। একটি হলো শরিয়তের পথ, অপরটি মারেফতের পথ’ (সূরা: মায়েদা, আয়াত-৪৮)।
আমাদের সমাজে দেখা যায় প্রায় সকল পিতা-মাতাই তাদের অতি আদরের সন্তানকে শরীয়তের এলেম অর্জনের জন্য বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় পাঠান। দেখা যায় ছোট ছোট বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে মা অথবা বাবাকে স্কুলের বাহিরে কষ্ট সহ্য করে বসে থাকতে। কারণ তাদের রক্ত পানি করে হলেও বাচ্চাদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলবেন। আবার এক সময় ওই ছেলে মেয়েরাই শিক্ষিত হয়ে মা বাবাকে ভুলে যায় কষ্ট দেয়। এর কারণ কি? এর মূল কারণ ছেলে মেয়েদের শরিয়তের শিক্ষায় শিক্ষিত করা হয়েছে, কিন্তু আল্লাহ প্রদত্ত মারেফতের বা আধ্যাত্মিক শিক্ষার ধারে কাছেও এদের পাঠানো হয়নি। ফলে তাদের শিক্ষা পরিপূর্ণ হয়নি। অনেকে মনে করেন পীরের কাছে গিয়ে আধ্যাত্মিক শিক্ষা অর্জন খুবই কঠিন কাজ এবং এ শিক্ষায় মানুষকে ঘর-বাড়ি ছেড়ে দিতে হয়! এ কথা সত্য নয় কারণ, ইসলাম কখনোই বৈরাগ্যবাদকে শিকার করে না। মূলত: যতটুকু আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করলে একজন মানুষের কল্ব গায়রুল্লাহর মহব্বত থেকে মুক্ত হয়, ততটুকু আধ্যাত্মিক শিক্ষা অর্জন করা অবশ্যই কর্তব্য। এই শিক্ষা অর্জনের জন্য ঘর-বাড়ি ত্যাগ করা জরুরি নয়। অন্তর যদি প্রশান্ত হয়, তাহলে তার অন্তরে কোন অবস্থাতেই খারাপ চিন্তা আসতে পারে না। কোন খারাপ কাজ করা সম্ভব হয় না। ফলে তার মাতা-পিতাকে কষ্ট দেয়া তো দূরের কথা, কষ্ট দেয়ার কথা চিন্তাও করতে পারে না। আমরা জানি, হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) কিভাবে তাঁর মায়ের খেদমত করতেন। তাঁর মা একদিন গভীর রাতে হযরত বায়েজিদ বোস্তামিকে বললেনÑ ‘আমাকে একটু পানি দাও তো বাবা, বড্ড পিপাসা পেয়েছে’। মায়ের জন্য পানি আনতে গিয়ে হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) দেখলেন বাড়িতে কোথাও একফোটা পানি নেই। ওই রাতে ছুটলেন নদী থেকে পানি আনতে। কিন্তু পানি এনে দেখলেন তাঁর মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুম থেকে মাকে জাগানো ঠিক হবে না। তাই পানির পাত্র হাতে সারারাত মায়ের শিয়রে দাঁড়িয়ে রইলেন। শীতের রাত হিমেল বাতাস আর কনকনে ঠা-ায় তাঁর হাত-পা অবশ হয়ে এলো, দু’চোখজুড়ে নামছে ঘুম। কিন্তু তিনি তা উপেক্ষা করে মায়ের ঘুম ভাঙার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়েই রইলেন। শেষ রাতে মায়ের ঘুম ভাঙলে দেখতে পেলেন তাঁর আদরের সন্তান বায়েজিদ দাঁড়িয়ে আছে হাতে পানির পাত্র নিয়ে। মা বললেন, তুমি এত কষ্ট করতে গেলে কেন বাবা? পানির পাত্র শিয়রে রেখে দিলেই তো পারতে। হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) বললেন, মাগো আপনার পিপাসার কথা মনে রেখেই আমি আর ঘুমাতে পারিনি। পুত্রগর্বে মায়ের বুক ভরে গেল, দুচোখ বেয়ে নেমে এলো আনন্দের অশ্রুধারা। আল্লাহর দরবারে হাত তুলে দোয়া করলেন ছেলের জন্য। স্বামীহারা মা নিজের কথা না ভেবে আদরের দুলাল একমাত্র সন্তান বায়েজিদ বোস্তামিকে সিরিয়ায় পাঠিয়েছিলেন, শুধু আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য। সেখানে তিনি হযরত জাফর সাদেক (রহ.)-এর সাক্ষাৎ পেয়ে তাঁর কাছে মুরিদ হন এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষা অর্জন করে আল্লাহর প্রিয় বন্ধুতে পরিণত হন। পৃথিবীতে যত অলি-আল্লাহর আগমন ঘটেছে তাদের সকলেই মা-বাবার সেবাযতœ করতেন। সুতরাং মাতা-পিতা জীবিত থাকা অবস্থায়ই সকল ছেলে মেয়ের উচিত কামেলপীরের কাছে বাইয়াত পড়ে শরিয়তের শিক্ষার পাশাপাশি তরিকতের আধ্যাত্মিক শিক্ষা অর্জন করা। এ শিক্ষা অর্জিত হলে, ছেলে-মেয়েরা পিতা-মাতার হক আদায় করতে সক্ষম হয়। এতে যেমন নিজেরাও উপকৃত হবে, তেমনি তাদের মেধা ও আদর্শ দিয়ে সমাজের শান্তিশৃংখলা বজায় রাখতে পারবে। পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য শুধু তাদের জীবিত অবস্থায়ই সীমাবদ্ধ নয়, পিতা-মাতার মৃত্যুর পরেও তাদের প্রতি সন্তানের কর্তব্য আছে।
আল্লাহতায়ালা পিতা-মাতার প্রতি সন্তানকে দোয়া করতে বলেছেন এই বলে, ‘ওয়াকুর রাব্বির হাম্হুমা কামা রাব্বাইয়া-নি ছ¦াগীরা’। অর্থ: হে আমার রব! আমার পিতা-মাতাকে রহমত কর, যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন। (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত-২৪)। সুতরাং পিতা-মাতার মৃত্যুর পরেও তাদের জন্য দোয়া করা প্রত্যেক সন্তানের কর্তব্য। আমাদের সমাজে দেখা যায় সন্তান পিতা-মাতাকে জীবিত অবস্থায় যেভাবে কষ্ট দেয় মৃত্যুর পরও তাদরে হক আদায় করে না, তাদের জন্য দোয়া করে না, পিতা-মাতার নামে দান খয়রাত করে না। অথচ পিতা মাতার জন্য দোয়া করলে কবরে তাদের নেকী বাড়তে থাকে। তারা কোন মসিবতে থাকলে এই দোয়ার বরকতে আল্লাহতায়ালা পিতা-মাতাকে ক্ষমা করে দেন।
যদি কোন সন্তান তরিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়, তাহলে তরিকার নিয়ম অনুসারেই তাদের পিতা মাতাকে প্রতিদিন দোয়া করতে হয়। আমার পীর-মুর্শিদ খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজান আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন- প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর তরিকার নির্দিষ্ট ওজিফা-আমল করে রাসুল (সঃ)-সহ সকল অলি-আল্লাহ ও পিতা-মাতার রূহে বকশিস করতে। যেমন ফজরের নামাজের পর ফাতেহা শরীফ পড়ে, জোহর নামাজের পর দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে, মাগরিব নামাজের পর দুই রাকাত নফল ও ফাতেহা শরীফ পড়ে এবং এশা’র নামাজের পর বেতের নামাজের আগে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে বকশিস করতে হয়। সুতরাং সন্তান যদি তরিকায় অন্তর্ভূক্ত হয় তাহলে পিতা-মাতার ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ সাধিত হয়। এছাড়াও সন্তান যদি কামেলপীরের তাওআজ্জ্হ্ নিয়ে আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে মোরাকাবা-মোশাহেদা করে, তাহলে ওই সন্তান কবর মোরাকাবার মাধ্যমে পিতা-মাতা কবরে কী অবস্থায় আছেন তা দেখতে পারে এবং আল্লাহর দরবারে তাদের জন্য দোয়া করে অবস্থার পরিবর্তন এনে দিতে পারে। মানুষ মরণশীল। মৃত্যুর পর শরিয়ত অনুসারে তার এবাদতের পথ বন্ধ থাকলেও পিতা-মাতার জন্য সন্তানের দোয়ার পথ খোলা থাকে। এই দোয়ার বদৌলতে পিতা-মাতা কবরে কঠিন আজাব হলেও তা থেকে রক্ষা পায়। তাই সকল পিতা-মাতার প্রতি আমার আহ্বান, যারা ইহকালে সন্তানের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এবং মৃত্যুর পর নিরন্তর দোয়া ও সন্তানের উন্নত চরিত্র আশা করেন, তারা তাদের সন্তানদের খাজাবাবা কুতুববাগীর সান্নিধ্যে পাঠিয়ে দিন। কুতুববাগী কেবলাজানের সান্নিধ্যে আসলে সন্তান অবশ্যই উন্নত চরিত্র গঠন করতে পারবে এবং মাতা-পিতার হক আদায়ে সন্তানেরা সামর্থ হবে।