কুতুববাগী কেবলাজানের প্রথম শিক্ষা ‘আদব’

সাইফুল ইসলাম দীপক

এমন একটা বিষয় নিয়ে লেখার দুঃসাহস করছি তা হল ‘আদব’। দুঃসাহস বলছি এ জন্য যে, আমার মধ্যে যে বিষয় পরিপূর্ণ নাই সেটা নিয়ে লেখা বড় ধৃষ্টতা। আমি গুরুজন বা মুরুব্বি দেখলে সালাম দিই, তার মানেই আমার ‘আদব’ আছে ব্যাপারটা তা নয়। বিষয়টা এতই গভীর তা আমার গুরু খাজাবাবা কুতুববাগী যদি দয়া করে কিছুটা না বুঝাতেন তা হলে সারাজীবন এক অজানার অন্ধকারেই থাকতাম। সত্যিকার অর্থে আদব হল সৃষ্টির সকল কিছুর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। তা সে ধনী, গরিব, মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণীই হোক, দেশের প্রেসিডেন্ট বা রাস্তার ভিখারিই  হোক না কেন, আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অন্তর থেকে আসা সহজ না। সুক্ষ্ম চিন্তা করলে দেখা যায় সত্যিকার অর্থে এই শ্রদ্ধাবোধ দৈনন্দিন জীবনে চলতে গিয়ে আমরা প্রায়শই ভুলে যাই। এর কারণ হচ্ছে ‘আমিত্ব’। আমার মধ্যে যে আমিত্ব সেই আমিত্ব-ই আমাকে আমার আদব  থেকে দূরে রাখে ।

আমিত্ব অনেকভাবে আসে। যেমন টাকা-পয়সা, বড় কোন ডিগ্রি অর্জন, কোন একটা বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান, বড় বংশ পরিচয়, সুন্দর দেহ, সুন্দর চেহারা, সামাজিক অবস্থান, পেশাগত সাফল্য এই রকম আরো অসংখ্য বিষয় আছে যার কারণে মানুষের মধ্যে আমিত্ব বা অহংকার আসতে পারে। আসলে পার্থিব বিষয়ের প্রতি আসক্তিই আমাদের আমিত্বের কারণ। আমার মহান গুরু খাজাবাবা কুতুববাগী সব সময় বলেন, ‘বাবারা নিজের আমিত্বকে বিলিন করে দেন। আর এটাই মহান আল্লাহকে পাওয়ার প্রথম ধাপ। যার অন্তরে আমিত্ব আছে, সে কখনো আল্লাহকে পাবেনা।’ এতদিন এ কথাটা শুনে আসছি তবু তেমনভাবে কিছুই বুঝিনি। আমি আসলেই মহা মূর্খ।

একদিন হঠাৎ চিন্তা এলো যে, আমরা ভাবি আমার অনেক টাকা, আমার দৈহিক সৌন্দর্য, আমার শিক্ষা। আসলে এইসব কি আমার কিছু? আমি কোন পরিবারে জন্মাবো তা কি আমি ঠিক করেছি? না। আমার দৈহিক সৌন্দর্য আমার তৈরি নয়, আমার মেধা আমার তৈরি নয়। আমি যদি এমন পরিবারে জন্মগ্রহণ করতাম, যে পরিবারের পিতা-মাতার পক্ষে আমাকে স্কুলে পাঠানোর সামর্থ্য নেই। তাহলে কীভাবে আমি পুথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত হতাম? আবার স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেও সবার মেধা সমান হয় না। কেউ লেখা পড়ায় অনেক ভালো আবার কারো পক্ষে পাশ করতেই কষ্ট হয়। এই পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার সবই তো মহান আল্লাহতায়া’লার সৃষ্টি এবং এর সব কিছুর মালিক তিনি। তাহলে মানুষ হিসেবে আমি কেন বড়াই করি, নিজের কৃতিত্ব দাবি করি। এই কথাটা নিজের উপলদ্ধিতে আসলেও সবসময় সেই ভাব মনের মধ্যে রাখতে পারা  সহজ নয়। একজন সাদা মনের মানুষ, সূফী মানুষ, যিনি সাধনার বলে এই অবস্থা হাসিল করেছেন, কেবল তিনিই পারেন এই ভাব মনের মধ্যে ধরে রাখার শিক্ষা দিতে। কীভাবে নিজের আমিত্বকে ধ্বংস করা যায় সূফী সাধকগণ যুগে যুগে এই শিক্ষাই দিয়ে আসছেন। আমার মহান শিক্ষক খাজাবাবা কুতুববাগীও সেই শিক্ষা দিচ্ছেন। আমার সূফীবাদের স্কুলের ছাত্র জীবনে এটুকুই উপলদ্ধি। জামানার সূফী সাধকগণ ক্রমাগত শিক্ষা দেন তাঁর শিষ্যদের মধ্য থেকে আমিত্ব বা অহংকারকে চিরতরে ধ্বংস করার। এই শিক্ষার একটা দিক হল সৃষ্টির সেবার মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভ করা। আমার মুর্শিদ-গুরু কুতুববাগী বলেন, শারীরিক ও আর্থিকভাবে মানব সেবার কথা। কিন্তু এখানেও একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে,  নিজের আমিত্বকে বিলিন করার জন্য আমার এই চেষ্টা। কারণ, অনেক সময় এমনও হয় যে, এই সেবা কর্মের দ্বারা নতুন করে আমিত্ব তৈরি হতে পারে। মনে হয় আমি অনেক কিছু করলাম, আর তাতেই জন্ম হল নতুন আমিত্ব। কি কঠিন এক দুষ্ট চক্র মানুষের মন বা নফস। একজন নামাজী, রোজাদার ব্যক্তির মধ্যেও আমিত্ব আসতে পারে। এ কারণে যে, আমি তো আমলধারী পরহেজগার হয়ে গেছি! আসলে এই নামাজ ও রোজার কোনই ফল নেই। আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের ভাব অন্তরে না জাগলে, কোন ইবাদত বন্দেগি আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। আমিত্ব নামক আত্মার রোগ দূর না হওয়া পর্যন্ত, পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের ভাব কখনো হবে না। আমরা শারীরিক অসুখ-বিসুখ নিয়ে অনেকেই অনেকভাবে চিন্তিত কিন্তু এরকম খুব কম মানুষই দেখি যারা আত্মার রোগ নিয়ে চিন্তা করেন। অথচ শরীর ক্ষণস্থায়ী আর আত্মা চিরস্থায়ী। হায়রে মানুষ! এই যে শরীরের রোগ তা ভালো হলেও মরতে হবে, না হলেও মরতে হবে। কিন্তু আত্মার রোগ নিয়ে কত হাজার বছর বাঁচতে হবে তা কি আমরা জানি? তবুও সেই আত্মার চিকিৎসা করাতে আমরা ক’জন এর জন্য যোগ্য ডাক্তারের কাছে ছুটে যাই?

আমাদের আত্মার ভিতরে অনেক রকম রোগ আছে, যেমন ক্রোধ, ঘৃণা, হিংসা, ঈর্ষা, লোভ ইত্যাদি। এগুলো একা একা সারাজীবন চেষ্টা করেও দূর করা সম্ভব না। এর জন্য আত্মার ডাক্তার প্রয়োজন। যে ডাক্তারের কাছে আল্লাহ প্রদত্ত আধ্যাত্মিক শক্তি আছে। অনেকেই এই কথা শুনে হয়ত বাঁকা হাসি হাসতে পারেন। ভাবছেন এই শুরু হল কুতুববাগী হুজুরের বন্দনা। এটা আসলে বন্দনা নয়, চিরসত্য ও আসল। আমি মূর্খ মানুষ। তাই চেষ্টা করছি এই মহাত্মার বাণী সমূহ প্রচার করতে। কারণ, আমি তা না করলে আল্লাহর কাছে ঠেকা থাকব। মহান আল্লাহ এই মনীষীর সান্নিধ্যে এনে আমাকে মানুষ হওয়ার রাস্তার সন্ধান দিয়েছেন। এই লেখা পড়ে যদি একজন মানুষও খাজাবাবা কুতুববাগীর সানিধ্যে এসে সত্য পথের সন্ধান পান, তাহলে আল্লাহর দরবারে আমার সামান্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হয়। সেই চেষ্টায় আছি এবং থাকতে চাই, যতদিন বেঁচে থাকবো। আর খাজাবাবা কুতুববাগীর শিক্ষা নিয়ে নিজের আমিত্বকে ধ্বংস করতে চাই, এটুকুই আমার আশা।

(Visited 342 times, 1 visits today)
Share