মোঃ আবুল খায়ের অনিক
‘মুর্শিদের প্রেমে পুড়ে যার অন্তর হইছে ছাই, তার দেহ মাটি খাবে, মাটির এমন সাধ্য নাই’। কামেল পীরের অনুসরণ ও অনুকরণ করার মানেই হচ্ছে তাঁদের মত প্রকৃত সাধক হওয়া, তাঁদের প্রেম-সাগরে ডুবে থাকাই হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষা অর্জন। যত বড়-ই দ্বীনদার; মুরিদ হন না কেন, পীরের মহব্বত অন্তরে জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত, আমরা কখনোই মুমিন হতে পারবো না। যারা অলি-আল্লাহদের প্রেমে মজে গেছেন, দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের কোন চিন্তা নেই। পরপারের কান্ডারী বা সাথীকে যে যত আপন করে নিতে পেরেছেন, তিনি তত আগেই সুপথ পেয়ে যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি যেমন লোককে ভালোবাসে, পরকালে সে তেমন লোকের সঙ্গেই থাকবে’ (বুখারী ও মুসলিম)। তাই একজন প্রকৃত গুরু ভক্তের জানা হয়ে যায় কি করলে আল্লাহর নৈকট্য পাওয়া যায়।
দেহের কাছে আত্মা যেমন প্রিয়, তেমনি আত্মার কাছে পরমাত্মা অতিপ্রিয়। তাদের মধ্যে মেলবন্ধনে দরকার একজন কামেল গুরু এবং নিবেদিত শিষ্য। কামেল গুরুর সঙ্গ দেওয়াই প্রকৃত সৎ সঙ্গ। এক গ্লাস পানিতে এক ফোটা পানি মিশালে যেমন ওই পানি ফোটার অস্তিত্ব আলাদা করা যায় না, তেমনিভাবে মুর্শিদের দিলের সঙ্গে যদি ভক্তের দিল মিশে যায়, তবেই ‘কলব’ হবে আল্লাহর জিকিরে জাগ্রত এবং অন্তরের চোখে ফুটবে আলো। মিটে যাবে আল্লাহকে দেখার তৃষ্ণা। শাহসূফী সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ শাহ চন্দ্রপুরী (রহ.) বলেনÑ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে ওঠা বসা করার ইচ্ছা করে, অর্থাৎ নৈকট্য লাভ করতে চায়, সে যেন তরিকত পন্থি কোন কামেল পীরের কাছে গিয়ে বাইয়াত হয়ে তাঁর সঙ্গে মিশে যায়’ (নূরতত্ত)। এই মিশে যাওয়ার প্রকৃত হাকিকত হচ্ছে, মুরিদের মনে যে কাটা বাসা বেঁধেছে তা সরিয়ে ফেলা। এ কাটা কোন কবিরাজ, সার্জারিয়ান বা মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বের করতে পারে না, বরং ক্ষত আরো বাড়বে ছাড়া কমবে না। এই কাটা বা আত্মার রোগ মুক্তি পাবার একমাত্র পথ হচ্ছে একজন কামেল মুর্শিদ। এই জগতে আমরা হচ্ছি আত্মার রোগী এবং কামেলপীর অলি-আউলিয়ার দরবার শরীফ হচ্ছে হাসপাতাল, আর কামেল পীর-মুর্শিদগণ হলেন সে হাসপাতালে সুচিকিৎসক। আমরা সাধারণ মানুষ যতই জরাগ্রস্থ হই না কেন, যতই পাপী হই না কেন, কামেল অলিগণের কাছে গেলেই মিলবে সকল রোগ মুক্তির মহাঔষধ।
পবিত্র কোরআন-হাদিসেই যখন সৎ সঙ্গ দিতে বলা আছে, সেখানে আমরা বসে বসে শুধু চিন্তা করে অমূল্য সময় নষ্ট করছি আর ভাবছি, পীর-মুর্শিদের কাছে যাওয়া ঠিক হবে কি না! আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অনুসরণ কর আল্লাহতায়ালার এবং রসুল (সঃ)-এর, আর তোমাদের মধ্যে যারা ধর্মীয় নেতা’ (সূরা নিসা : আয়াত-৫৯)। প্রিয় নবী রসুল (সঃ) বিদায় হজের ভাষণে বলেনÑ ‘তোমাদের নিকট আমি দুটি ভারী বস্তু রেখে গেলাম। যতদিন এ দুটিকে ধরে রাখতে পারবে ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। এর মধ্যে একটি আল্লাহর কিতাব কোরআন, যার মধ্যে ইসলামের সব দিক-নির্দেশনা দেওয়া আছে, আর অপরটি হচ্ছে আমার আহলে বাইয়াত’। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল, এখনকার মানুষ শুধু প্রথমটিকেই প্রাধান্য দেয় আর দ্বিতীয়টির ভ্রুক্ষেপ করে না। আর এ কারণেই দিন দিন মানুষের ঈমান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বিনয়-ভদ্রতা, শালিনতা আর মানবিকতার দিকগুলো আজ হুমকির মুখে! রসুল (সঃ)-এর নির্দেশ অনুযায়ি না চলাতে আমরা সত্যিই পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ছি। দুই হাতের সমান শক্তি যেমন এক হাতে পাওয়া যায় না, তেমনি আহলে বাইয়াত বাদ দিয়ে শুধু কোরআনের আংশিক আমল বুঝে, কিছু না বুঝে আবার অনুমানে ভর করে কেউ কখনোই জান্নাত বা আল্লাহর দেখা পাবে না। আদিপিতা হযরত আদম (আঃ) থেকে এখন পর্যন্ত আল্লাহকে পাওয়ার রাস্তার কোন পরিবর্তন আসেনি আর আসবেও না। সকল ক্ষেত্রেই উছিলার মাধ্যমেই দেখা-দেখি, জানা-জানির পথ পাওয়া যায়। হযরত ইমাম গাজ্জালী (রহ.) বলেনÑ ‘তুমি যদি আল্লাহর সঙ্গে মিশতে চাও, তবে চিরতরে কামেলের চরণ ধূলি-সম হয়ে যাও’। চারটি মাজহাবের চারজন ইমাম তাঁরাও পীর-মুর্শিদের মুরিদ ছিলেন। আমার মুর্শিদ খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজান হুজুর যিনি মাতৃগর্ভ থেকেই অলিত্বের ভার নিয়ে দুনিয়াতে এসে, আমাদের প্রাণপ্রিয় দাদাপীর হযরত শাহ মাতুয়াইলী (রহ.)-এর মুরিদ হয়ে, দীর্ঘ দশ বছর জান-মাল উজার করে আপন পীরের খেদমত করেছেন, শুধু আপন মুর্শিদের প্রেম-মহব্বত অর্জনের জন্য।
একটা ঘটনা বলি, একদিন কয়েকজন লোক আম বাগানের বাহিরে বসে পরামর্শ করছিল, কীভাবে আম চুরি করবে। কেননা গাছের মালিকের হাতে ধরা পড়লে তো তাদের শাস্তি দিবে। সবাই বসে ঠিক করল যে, দুপুরে যখন বাগানের মালিক থাকবে না, তখন সবাই গাছে উঠে আম চুরি করবে। এ সময় তাদের কাছাকাছিই বসে ছিল এক লোক, তাকে কেউ খেয়াল করলো না, যখন বসা থেকে লোকটি দাঁড়িয়ে মুচকি হাসি দিয়ে আস্তে আস্তে বাগানের দিকে গেল এবং বাগানের মালিকের কাছে তার আম খাওয়ার ইচ্ছা জানাল। বাগানের মালিক তার লোক দিয়ে কিছু আম এনে লোকটিকে দেয় এবং সে তৃপ্তি মিটিয়ে আম খেয়ে চলে গেল। এই দৃশ্য দেখে বাগানের বাহিরে বসে থাকা সেই লোকগুলো বুঝতে পারলো, আজ যদি বাগানের মালিকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকত, তবে আর চুরি করতে হতো না। উল্লেখিত ঘটনার মাধ্যমে বোঝা গেল যে, আপন পীরের সঙ্গে শিষ্যের সম্পর্ক যত গভীর হবে, তাদের চাওয়া পাওয়া ততই দ্রুত পূরণ হবে। যে যত বেশি কামেল পীরের মহব্বত হাসিল করবে, তার আত্মা তত বেশি শুদ্ধ হবে এবং সে তত তাড়াতাড়ি আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবে।