শাহসূফী আলহাজ মাওলানা হযরত সৈয়দ জাকির শাহ নকশবন্দি মোজাদ্দেদি কুতুববাগী
ওরছ শরীফকে আরবীতে বলা হয় ‘আরুস’ আর ‘শরীফ’ অর্থ পবিত্র। ওরছের আভিধানিক অর্থ- ‘শাদী’ আর শাদী ফার্সী শব্দ। এ জন্যই বর-কনেকে আরবী ভাষায় ওরছ বলা হয় অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর দেখা-সাক্ষাৎ বা মিলন। তাই বুযুর্গানেদ্বীনের ওফাত দিবসকে ওরছ বলা হয়ে থাকে। কারণ, বুযুর্গব্যক্তিরা ইন্তেকাল প্রাপ্ত হলে তাঁর রবের সাথে দেখা হয়, মিলন হয়। মিশকাত শরীফে কবরে আজাবের প্রমাণ শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে, যখন মুনকার-নাকির কবরবাসীর পরীক্ষা নেয় এবং যখন সে পরীক্ষায় কৃৃতকার্য হয়, তখন তাকে বলেন- আপনি সেই দুলহানীর মত শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন, যে ঘুম থেকে আপনার প্রিয়জন ছাড়া আর কেউ জাগাতে পারে না। মুনকার নাকির রাসুল (সঃ)-কে দেখিয়ে জিজ্ঞাস করবেন, ওনার সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? নেককার ব্যক্তি উত্তরে বলবেন, তিনিই তো সৃষ্টিজগতের শ্রেষ্ঠ দুলহা। কবরে ওইদিন রাসুল (সঃ)-এর সাথে উম্মতের সাক্ষাতের দিন, নিশ্চয়ই সে কারণে এ দিনকে ওরছের দিন বলা হয়। বাস্তবিক অর্থে পীরে কামেল মোকাম্মেল অলিআল্লাহর ওফাত দিবসে প্রতি বছর কোরআন-হাদিস মতে ইসলামী মাহফিল কোরআন তিলওয়াত ও দান সদকা ইত্যাদি বিষয়ের জন্য ছওয়াব হাসিল করা ও ইন্তেকাল প্রাপ্ত ব্যক্তির রূহে ছওয়াব পৌছানোকে ওরছ বলা হয়। তাফসীরে কবীর ও তফসীরে দুর্রে মনসুরে উল্লেখ আছে, রাসুল (সঃ) প্রতি বছর শহীদদের কবরে তাশরীফ নিতেন এবং শহীদানদের সালাম দিতেন। চার খলিফাগণও অনুরূপ করতেন।
শাহ আব্দুল আযীয ছাহেব ফতওয়ায়ে আযীযিয়ার ৪৫ পৃষ্ঠায় বলেছেন, অনেক লোক একত্রিত হয়ে এবং খতমে কোরআন পড়া হয়, আর খাদ্যদ্রব্য শিরনীর ফাতিহা দিয়ে সমবেত ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এ ধরণের রীতি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম ও খুলাফায়েয় রাশদীনের যুগে ছিল না। কিন্তু কেউ যদি করে, তাতে কোন ক্ষতি নেই বরং জীবিতগণ কবরবাসীর দ্বারা লাভবান হয়। ‘যুবদাতুন নসায়েহ ফি মসায়েলিয যবায়েহ’ গ্রন্থে শাহ আব্দুল আযীয ছাহেব (রহ.) মৌলভী আব্দুল হাকিম ছাহেব শিয়ালকোটির একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেছেনÑ ‘মানুষের অবস্থা সম্পর্কে অবগত না হওয়ার কারণেই এ অপবাদ দেয়া হয়, কোন ব্যক্তিই শরিয়তের নির্ধারিত ফরজসমূহ ব্যতীত অন্য কিছুকে ফরজ মনে করে না। তবে নেক বান্দাদের কবরসমূহ থেকে বরকত লওয়া এবং ঈসালে ছাওয়াব, কোরআন তিলাওয়াত, শিরনী ও খাদ্যদ্রব্য বণ্টন দ্বারা ওদের সাহায্য করা উলামায়ে কিরামের মতে ভালো কাজ। মৌলভী রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী ও আশরাফ আলী থানভীর পীর হাজী ইমদাদুল্লাহ মোহাজের-এ মক্কী ছাহেব রচিত ‘ফয়সালা-এ-হাফতে মাসায়েল’ পুস্তিকায় ওরছ জায়েয হওয়া সম্পর্কে জোরালো অভিমত ব্যক্ত করেছেন এবং স্বীয় আমলের কথা এভাবে বর্ণনা করেনÑ ফকীরের বিনয় এই যে, প্রতি বছর আমি আমার পীর-মুর্শিদের পবিত্র আত্মার প্রতি ইসালে ছওয়াব করে থাকি। প্রথমে কোরআনখানি হয়, এরপর যদি সময় থাকে মিলাদ শরীফের আয়োজন করা হয় এবং উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে খাবার পরিবেশন করা ও এর ছওয়াবও বখশিশ করে দেয়া হয়। মৌলভী রশীদ আহমদ ছাহেবও ওরছকে জায়েয বলেছেন। যেমন ফতওয়ায়ে রশিদিয়া প্রথম খ- কিতাবুল বিদআতের ৯৬ পৃষ্ঠায় বলেছেন- আরববাসী থেকে জানা যায় যে, মক্কা শরীফের লোকেরা হযরত সৈয়দ আহম্মদ বদ্দবী (রহ.)-এর ওরছ অনেক ধুমধাম সহকারে পালন করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে মদীনা মনোয়ারার আলিমগণ হযরত আমীর হামযা (রাঃ)-এর ওরছ করে থাকেন, যার পবিত্র মাযার উহুদ পাহাড়ে অবস্থিত।
দেওবন্দের পীর আশরাফ আলী থানভী সাহেব, রশিদ আহমেদ গাংগুহী সাহেব, কাশেম নানুতভী সাহেব, খলিল আহমেদ আম্ভাটভী সাহেবদের পীর হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজের-এ মক্কি (রহ.)-এর কিতাব (ফায়সালা-এ হাফতে মাসায়েল) থেকে বর্ণনা তুলে ধরতেছিÑ তিনি লিখেন যে, মৃত্যুর পরে নেক বান্দাদেরকে বলা হবে দুলহার মত শুয়ে পরো। নেক বান্দাদের বেলায় ইন্তেকাল হল মাহবুবে হাকীকির সাথে মিলনের নাম। এ জন্যই তাদের মৃত্যুকে বেসাল বা মিলন বলা হয়। মাহবুবে হাকীকির সাথে মিলনের চেয়ে আনন্দের বিষয় আর কী হতে পারে? ওরছের নিয়ম চালু করার উদ্দেশ্য ছিল বুযুর্গানেদ্বীনের রুহের প্রতি ইসালে সওয়াব করা, যা মহান আল্লাহর খুবই পছন্দনীয় কাজ। যে সব পূর্ণবুযুর্গ থেকে আমরা ফয়েয বরকত লাভ করেছি, এ ব্যাপারে আমাদের ওপর তাদের অধিক হক রয়েছে। এবং প্রতি বছরে ওরছ শরীফে পীর ভাইদের সাথে পরস্পর মিল মুহব্বত ও ভ্রাতৃত্ববোধ বৃৃদ্ধি পায় ও ইসলামের জযবা তৈরী হয়।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আলা ইন্না আউলিয়া আল্লাহি লা খাওফুন আলাইহীম ওয়ালাহুম ইয়াহযানুন।’ অর্থ- সাবধান নিশ্চয়ই আউলিয়াগণের কোন ভয় নেই, তারা কোনো কারণে কখনো দুঃখিত বা চিন্তিত হবেন না।’ রাসুল (সঃ) বলেছেন, আউলিয়া আল্লাহি লাইয়ামুতুন।’ অর্থ- কোন অলির কখনো কোন সময় মৃত্যু নেই।’ আবার সুরা আল বাক্বারাহ: ১৫৪ আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, অর্থ- আর যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদেরকে মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বুঝ না।’ এই আয়াতের সারমর্ম হলো আল্লাহর খাস বান্দা বা বন্ধু-অলিআল্লাহগণ সাধনায়রত অবস্থায় দারুল ফানা থেকে দারুল বাকায় অবস্থান করেন। অতএব তাঁদের মৃত মনে করা চরম অন্যায়। পবিত্র কোরআনে সুরা আল ইমরান ১৬৯ আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেনÑ ‘আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে করো না, বরং তারা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও রিজিকপ্রাপ্ত।’ মহান আল্লাহতায়ালা সুরা আ’রাফ : ১৭৯ আয়াতে বলেন, ‘আর আমি সৃষ্টি করেছি দোযখের জন্য বহু জ্বিন ও মানুষ, তাদের অন্তর রয়েছে, তার দ্বারা বিবেচনা করে না, তাদের চোখ রয়েছে, তার দ্বারা দেখে না, আর তাদের কান রয়েছে, তার দ্বারা শোনে না. জন্তুর মত তারা চতুষ্পদ; বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর, তারাই হল গাফেল, শৈথিল্যপরায়ণ।’ এখন কথা হলো, মহান আল্লাহতায়ালা স্বয়ং যেখানে ঘোষণা করেছেন যে, তাঁর অলিবন্ধুরা কখনো মরেন না এবং কবরে তাঁদের জন্য রিজিক দান করেন, সেখানে তাঁদেরকে মৃত বলা আল্লাহর বাণীর বিরোধিতা করার শামিল নয় কি? আর আল্লাহর বিরোধিতাকারীর শাস্তি কেমন হবে তাও পবিত্র কোরআনে বিশদভাবে উল্লেখ আছে। তাই এসমস্ত আউলিয়াকেরামগণের ওফাত দিবসে তাঁদের স্মরণে ওরছ শরীফ বা ফাতেহাখানি ও সদকা, মান্নত করে তাবারকের ব্যবস্থা করা হয়, বিশেষ এ তাবারক গ্রহণ করে মানুষের দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তিলাভ করছে এবং রহমত ও বরকতপ্রাপ্ত হন। পাঠকগণ, পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের মর্ম-মূলে কি বলা হয়েছে তা যদি একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেন তবে আপনাদেরও জ্ঞান-চক্ষু খুলে যাবে।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহুর বর্ণনায় এসেছে যে, আল্লাহর রাসুল (সঃ) কবরের বর্ণনা দিতে গিয়ে মালাইকার (ফেরেশতার) মুখ দিয়ে নেককার লোকদের বলেনÑ ‘নাম কানাওমাতিল আরুস’ অর্থাৎ, তুমি বাসর রাতের বর কনের মত ঘুমাও, (তিরমিজি, মিশকাত শরীফ)।’ অন্য জায়গায় আছে, ওরছ শব্দের অর্থ বাসর রাতের মিলন, ওলীমার খানা ও খুশী ইত্যাদি, (মিসবাহুল লুগাত ৫২০ পৃষ্ঠা)। যেহেতু পবিত্র কোরআন মতে একজন কামেলঅলি কখনো মৃত নয় তাঁরা মহান আল্লাহর তরফ থেকে রিজিকপ্রাপ্ত হন। কারণ তাঁরা পুত:পবিত্র, তঁাঁদের সমাহিত স্থান আল্লাহর রহমত পাবার স্থান। সুরা আরাফ-এর আয়াত ৫৬ এ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পৃথিবীকে কুসংস্কারমুক্ত ও ঠিক করার পর তাতে অনর্থ সৃষ্টি করো না, তাকে আহবান কর ভয় ও আশা-সহকারে নিশ্চয় আল্লাহর করুণা সৎকর্মশীলদের নিকটবর্তী।’ এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বিশেষভাবে নবী-রাসুল ও অলিআল্লাহরাই আল্লাহর তরফ থেকে খাস করুণাপ্রাপ্ত হন সে কারণেই তাঁরা পুত:পবিত্র। তাই সময়ের আবর্তে ধর্মের ভিতরে কিছু অধর্ম ঢুকে গেলে জামানার মোজাদ্দেদ আউলিয়াগণ সেই সমাজ থেকে ধর্মের নামে অধর্ম মুছে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ তৈরিতে স্বচেষ্ট হন।
পাঠক এখন আপনারাই ভেবে দেখুন, স্বয়ং আল্লাহতায়ালা যাঁদেরকে এত মর্তবা দান করে তাঁদের উছিলায় সাধারণ মানুষদের নাজাতের বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়েছেন। তাঁদের প্রতি আমাদের কর্তব্য থেকে কেনো গাফেল হয়ে থাকবো? এটা আদবের খেলাফ নয় কি? ওরছ শরীফে আসবেন ফয়েজ, বরকত, রহমত ও নিয়ামত হাসিল করতে এবং ওরছ শরীফ থেকে প্রকৃৃত মুত্তাকিন কখনো খালি হাতে ফিরে যায় না। সুরা আল ফাতহা আয়াত ১০এ আল্লাহ বলেনÑ ‘যারা আপনার কাছে আনুগত্যের শপথ করে, তারা তো আল্লাহর কাছে আনুগত্যের শপথ করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর রহিয়াছে। অতএব, যে শপথ ভঙ্গ করে; অতি অবশ্যই সে তা নিজের ক্ষতির জন্যই করে এবং যে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে; আল্লাহ দ্রুতই তাকে মহাপুরস্কার দান করবেন।’ তাই দিধামুক্ত হয়ে বলছি, এক আল্লাহর আনুগত্যশীলরাই পবিত্র ওরছে এন্তেজাম করে থাকেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিতÑ নবী করিম (সঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার মুর্শিদের থেকে এমন কিছু দেখতে পায় যা সে অপছন্দ করে, তাহলে সে যেন ধৈর্যধারণ করে কেননা. যে ব্যক্তি এক বিঘাত পরিমান জামাত হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে মৃত্যুবরণ করলো সে জাহেলিয়াত যুগের ন্যায় মৃত্যুবরণ করলো।’
ওরছ শরীফের সাজ-সজ্জা
সৌন্দর্য বিষয়ে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে সুরা বাকারা ১৩৮ আয়াতে বলেনÑ ‘ছিবগাতাল্লাহি ওমান আহ্ছানু মিনাল্লাহি ছিবগাহ।’ অর্থ- আল্লাহর রঙে রঙিন হও, আল্লাহর চেয়ে উত্তম রঙ আর কার আছে।’ আল্লাহর সৌন্দর্য এবং পছন্দের ব্যাপারে হাদিস শরীফে রাসুল (সঃ) বলেনÑ ‘ইন্নাল্লাহা জামিল ওয়া ইউহিব্বুল জামাল।’ অর্থ- নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি সুন্দর, তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন।’ এখন আপনারাই বলেন, আল্লাহর বাণীর গুরুত্ব বেশি? না সৌন্দর্য বৃদ্ধির বিপরীতে গোমরাহী লোকদের গুরুত্ব বেশি? কিন্তু ইদানিংকালে যারা ওরছ শরীফের বিরোধিতা করেন, সাজসজ্জার বিরোধিতা করেন তাদের জানা ও বোঝার জন্য বলছি, মহান আল্লাহতায়ালা কত সুন্দর করে অধিক মমতা দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এই বিশ্ব প্রকৃতি তাকিয়ে দেখুন, যেদিকে তাকাবেন দুচোখ জুড়িয়ে যাবে তবু দেখার স্বাদ মিটবে না। আর এ অপরূপ সৃষ্টির সুমহান ¯্রষ্টা যিনি তিনি কতটা সুন্দর হতে পারেন, তা সাধারণের চিন্তারও বাইরে! তাই তারা ওরছ শরীফকে ঘিরে আলোকসজ্জা বা ঝাঁকঝমকপূর্ণ সাজ-সজ্জার বিরোধিতা করে থাকেন। এমন করবেন না এতে আল্লাহতায়ালা এবং তাঁর অলিবন্ধুরা বেজার হন, না খোশ হন। আমরা সাধারণত কোন অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করলে সেখানে সাজ-সজ্জা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা করি। আর যেখানে কোরআন-হাদিস ও অলিআউলিয়াগণের শানমান আলোচনা করা হয়, সে স্থানের পরিবেশে সুন্দর আলোকসজ্জা করলে আপনাদের কেনো ভালো লাগে না? হয়তো ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে। এ সমস্ত গোমরাহী পথ ও মত পরিহার করে কামেল পীরের হাতে বাইয়াত নিয়ে পরিশুদ্ধ মানুষ হওয়ার জন্য চেষ্টা তদবির করুন, তবেই মহান আল্লাহতায়ালা সবাইকে হেদায়েদ দান করবেন ইনশাআল্লাহ।